বিপদ যখন নিয়ামাত
ইংরেজীতে একটা প্রবাদ আছে- Life isn’t a bed of roses (জীবন পুষ্পশয্যা নয়)। এ কথাটি যেন মুমিন জীবনের জন্য এক কঠোর বাস্তবতা। মু্মিন ব্যক্তি তাঁর মৃত্যুর আগ পর্যন্ত নানা চড়াই-উৎরাই পার হতে থাকে। তাঁর ঈমানের স্তর অনুযায়ী তাঁর বিপদগুলো ছোট থেকে বড় আকার ধারণ করতে থাকে। তবে এর কোনটিই তাঁর সামর্থ্যকে অতিক্রম করে না। কারণ আল্লাহ বলেছেন,
“আল্লাহ কাউকে তার সাধ্যাতীত কোন কাজের ভার দেন না।”- (সূরা বাকারাহ: ২৮৬)
স্বভাবতই যে কেউই বিপদ আসলে হতাশায় ভোগে। আমার ক্ষেত্রেই কেন এমন হলো? আমিই বুঝি একমাত্র মানুষ, যে এমন বিপদের সম্মুখীন হলাম, বাকি সবাই কত আরাম আয়েশে জীবনযাপন করছে! কতই না হাসিখুশি তারা! কাউকে ত আমার মত মন খারাপ করে থাকতে দেখি না! এমন আরো অনেক চিন্তা এসে ভর করতে থাকে একজন সাধারণ বিপদগ্রস্থ মানুষের মনে। কিন্তু মুমিনের ব্যাপারটা সম্পূর্ণ ভিন্ন। মুমিন ব্যক্তিকে দেয়া হয়েছে সবরের শিক্ষা। আল্লাহ জানিয়ে দিয়েছেন, তাঁর এই সবরের বিনিময়ে রয়েছে পরকালে অসীম পুরষ্কার। এই পুরষ্কারের আশায়, সে চলমান বিপদকে তুচ্ছজ্ঞান করতে পারে। আল্লাহ বলেন,
“এবং অবশ্যই আমি তোমাদিগকে পরীক্ষা করব কিছুটা ভয়, ক্ষুধা, মাল ও জানের ক্ষতি ও ফল-ফসল বিনষ্টের মাধ্যমে। তবে সুসংবাদ দাও সবরকারীদের।”-(সুরা বাকারাহ: ১৫৫)
মুমিন মাত্রই জানে, এই বিপদ তার জন্য পরীক্ষা। এই পরীক্ষা ক্ষণস্থায়ী। সে শিখেছে ধৈর্যধারণ করেই এই পরীক্ষা অতিক্রম করতে হবে। আবার সুখের সময়ও সে আত্মহারা হয়ে যায় না। সে রবের শোকরিয়া জ্ঞাপনে মনোনিবেশ করে। এই ব্যাপারটি ফুটে উঠেছে সুন্দর এক হাদীসের মাধ্যমে।
রসুলুল্লাহ সল্লাল্লাহু আ’লাইহি ওয়া সাল্লাম বলেন, “মুমিনের বিষয়টি বড়ই বিস্ময়কর! তার সবকিছুই কল্যাণকর; মুমিন ছাড়া কারো ক্ষেত্রে এটি প্রযোজ্য নয়; তার জীবনে সুখ সমৃদ্ধি এলে সে কৃতজ্ঞতা জ্ঞাপন করে, ফলে তা তার জন্য হয় কল্যাণকর। আর দুঃখ-দুর্দশার সম্মুখীন হলে সে ধৈর্যধারণ করে, ফলে তাও হয় তার জন্য কল্যাণকর।”- (মুসলিম: ২৯৯৯)
মুমিন ব্যক্তি আল্লাহর প্রিয় বান্দা। এই বিপদগুলো তাঁর ঈমানেরই পরিচায়ক। আল্লাহ ত তাঁর প্রিয় বান্দাদের উচ্চ মর্যাদা দিতে চান। অনেক সময় তাঁদের আমল যথেষ্ট হয় না এই মর্যাদায় পৌঁছুতে, তখন এই বিপদের মুহূর্তগুলোই তাঁকে সাহায্য করে আল্লাহর নির্ধারিত স্থানে পৌঁছুতে। আর বান্দা যেন এসময় নিজেকে দৃঢ় রাখতে পারে, তাই আল্লাহ তাঁর প্রিয় হাবীবের মাধ্যমে আমাদের জানিয়ে দিয়েছেন,
“মুসলিম ব্যক্তির উপর যেসব যাতনা, রোগ-ব্যাধি, উদ্বেগ-উৎকন্ঠা, দুশ্চিন্তা, কষ্ট ও পেরেশানী আপতিত হয়, এমনকি যে কাঁটা তার দেহে বিদ্ধ হয়, এসবের মাধ্যমেও আল্লাহ তার গুনাহসমূহ মাফ করে দেন।”- (বুখারী: ২১৩৭)
পাশাপাশি, কুরআনে আল্লাহ আমাদের জন্য রেখেছেন উজ্জ্বল সব দৃষ্টান্ত। আইয়ুব (আ) এর অসুস্থতা, ইউসুফ (আ) এর কারাগারবাস, ইউনুস (আ) এর সমুদ্রের গভীরে তিমির পেটে দিনাতিপাত, ইব্রাহীম (আ) এর পুরো সমাজের বিরুদ্ধে অবস্থান প্রভৃতি বিভিন্ন পরিস্থিতিগুলো আমাদেরকে বিপদের দিনে আশার আলো হয়ে পথে দেখায়।
মুমিনের জীবনে প্রতিটি বিপদ যেন একেকটা নিয়ামত। এই দুনিয়াবী ক্ষণস্থায়ী বিপদ দিয়ে সে অতিক্রম করতে থাকে পরকালীন মহাবিপদগুলো। শুধু যে পরকালীন শাস্তি থেকে রেহাই পেয়ে যায় তা না, সে অর্জন করে রবের সন্তুষ্টি। সে হতে থাকে এক পরিশুদ্ধ আত্মা। জান্নাতেও সে এগুতে থাকে উচ্চতম স্তরের দিকে।
গ্রন্থ পর্যালোচনা:
বইয়ের ১ম অংশে উস্তাদা শাওয়ানা এ আযীয নয়টি অনুচ্ছেদে তুলে ধরেছেন বিপদের স্বরূপ। বিপদ কেন আসে? কিভাবে আসে? বিপদের সময় কি করণীয়? বিপদকে কাজে লাগিয়ে কিভাবে আল্লাহর সন্তুষ্টি আদায় করতে হয়, তার পরিপূর্ণ নসীহাহ পাওয়া যাবে।
উল্লেখযোগ্যভাবে, বিপদকে নিয়ামাতে বদলে নিতে তিনি কিছু গুরুত্বপূর্ণ আমলের বর্ণনা দিয়েছেন: সবর, ইস্তিরজা, ইহতিসাব ও শাকওয়া।
বইয়ের ২য় অংশে শাইখ মুসা জিবরীলের বর্ণনায় এসেছে নিজেকে বিপদে ধীরস্থির রাখার মূলমন্ত্র। বিপদে কিভাবে দুআ করতে হবে, কিভাবে দুআকে শক্তিশালী করে বিপদকে অতিক্রম করতে হবে, তাও দেখিয়ে দেয়া হয়েছে। উল্লেখযোগ্যভাবে, এখানে তিনি তাকদীরের এক মৌলিক নীতি শিক্ষা দিয়েছেন, যা কিছু ঘটে আল্লাহর ইচ্ছাতেই ঘটে। আর আল্লাহর ফয়সালাতে কোন মুমিন বান্দা অসন্তুষ্টি প্রকাশ করতে পারে না।
আর বইয়ের শেষাংশে উস্তাদ আলী হাম্মুদার দেয়া ১৫টি প্রতিষেধক থেকে আপনি বাঁচাই করে নিতে পারেন আপনার ওষুধটি, যা দিয়ে আপনি বিষণ্বতা কাটিয়ে, আল্লাহর ইবাদাতে মনোনিবেশ করতে পারবেন।
“বিপদ থেকে নিয়ামত” বইটি আমাদের পরিচয় করিয়ে দেয় মুমিনের অদ্ভুত কিছু বৈশিষ্ট্যের সাথে। প্রতিকূল পরিস্থিতিতে নিজেকে দ্বীনের পথে অটল রাখার খুবই চমৎকার এক ম্যানুয়াল এটি।
Post a Comment