আসসালামু আলাইকুম, আজ আমরা আলোচনা করবো ইসলামে কোন কোন সম্পদের উপর দেয়া জাকাত ফরজ ও জাকাত র হিসাব নিয়ে। ইসলামী অর্থায়নে জাকাত একটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ বিধান। একজন বিত্তবান ব্যক্তি মুসলিম সমাজের অন্তর্ভুক্ত হওয়ার যোগ্য হন ঈমান ও নামাজের পর নিয়মিত জাকাত প্রদানের মাধ্যমে। জাকাত নিয়ে অনেকের মনে অনেক প্রশ্ন আছে। অনেকে আবার ভাবছেন, জাকাত কোন সম্পদের উপর ফরজ? আরো জানতে সম্পূর্ণ পোস্টটি পড়ুন।
আসুন জেনে কোন কোন সম্পদের উপর জাকাত দেয়া ফরজ।
আজকে জাকাত সম্পর্কে ২০টি মাসয়ালা সম্পর্কে জনাবো। নিচে জাকাত সংক্রান্ত মাসালা উল্লেখ করা হচ্ছে। কোন কোন সম্পদের উপর জাকাত ফরজ তা জানতে সম্পূর্ণ আর্টিকেলটি পড়তে থাকুন।
মাসয়ালাঃ-১
একজন প্রাপ্তবয়স্ক এবং বুদ্ধি-জ্ঞান সম্পন্ন মুসলমানের (নারী-পুরুষ) মালের উপর কিছু শর্তসাপেক্ষে জাকাতকে ফরজ করা হয়েছে। যেসব শর্ত থাকলে আকপনার উপর উপর জাকাত ধার্য করা হবে তা নিচে দেওয়া হল;- মালের উপর পূর্ণ একটি (চান্দ্র) বছর তার পূর্ণ মালিকানা বিদ্যমান থাকতে হবে।
- জাকাত ধার্য হতে পারে এমন প্রকৃতির মাল হতে হবে।
- নিসাব পরিমাণ সম্পদ অথবা নিসাবের মূল্যের সমপরিমাণ।
- ওই হিসাব পরিমান সম্পদ তার মৌলিক প্রয়োজনের অতিরিক্ত থাকতে হবে।
মালিকানা বলতে বোঝানো হয়, “কোন বস্তু বা ব্যক্তির মধ্যকার শরীয়ত সম্মত যোগ সূত্র কে বোঝায়। যেটা ব্যক্তিকে ওই বস্তু নিঃশর্তভাবে ব্যবহারের অধিকার দিয়ে থাকে এবং অপর লোকের হস্তক্ষেপে বাধা দেয়।”
নগদ অর্থ, স্বর্ণ-রৌপ্য, বাণিজ্য, গবাদিপশু, কৃষিজাত দ্রব্য ইত্যাদির উপর জাকাত ফরয। দানকৃত সম্পত্তি, সরকারি সম্পত্তি, নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিসপত্র, বাসস্থান ইত্যাদির জাকাত বাধ্যতামূলক নয়।
কৃষিপণ্য, ফল ইত্যাদির ক্ষেত্রে সারা বছর মালিকের দখলে থাকা বা থাকা আবশ্যক নয়। যখনই সম্পদ অর্জিত হয় তার উপর জাকাত ধার্য করা হয়। নির্দিষ্ট সম্পদের জন্য জাকাত ফরজ সম্পর্কে আরও জানতে সম্পূর্ণ আর্টিকেলটি পড়া চালিয়ে যান।
সম্পদকে ৪০ ভাগ করে তার এক ভাগ জাকাত দিতে হবে অর্থাৎ শতকরা আড়াই ভাগ জাকাত হিসেবে প্রদান করতে হবে। এই হিসেবে অতিরিক্ত মালের উপরও জাকাত ফরজ হয়ে যায়। কেউ চাইলে জাকাত নগদ অর্থ দিয়ে পরিশোধ করতে পারে অথবা সংশ্লিষ্ট মাল দিয়েও তা পরিশোধ করার সুযোগ রয়েছে। (কোন কোন সম্পদের উপর জাকাত দেয়া ফরজ )
মাসয়ালাঃ-২
স্বর্ণ, রূপা ও ক্যাশ টাকা নিসাব পরিমাণ হওয়ার পর তা নিত্যপ্রয়োজনীয় খরচ হতে অতিরিক্ত হওয়া জাকাত ফরজ হওয়ার মৌলিক শর্ত। সুতরাং মালিকানাধীন জমি, বসবাসের বাড়ি ও চলাফেরার বাহন-গাড়ি ইত্যাদির ওপর জাকাত ওয়াজিব হবে না। বিক্রয়ের উদ্দেশ্য ছাড়া ক্রয়কৃত জমির ওপর জাকাত ওয়াজিব নয়। -আদ্দুররুল মুখতার: ২/৩০৩
মাসয়ালাঃ-৩ +
প্রয়োজনীয় থাকার ঘর নির্মাণের উদ্দেশ্যে জমাকৃত নিসাব পরিমাণ টাকার ওপর চন্দ্র বছর অতিবাহিত হলে নির্ভরযোগ্য মতানুসারে জাকাত ওয়াজিব হবে। তবে বছর পূর্ণ হওয়ার পূর্বে ওই টাকা দ্বারা নির্মাণসামগ্রী ক্রয় করে নিলে এর ওপর জাকাত ফরয হবে না। -রদ্দুল মুহতার ২/২৬২
মাসয়ালাঃ-৪
সমিতি ও ব্যাংকে জমাকৃত টাকা নিসাব পরিমাণ হলে বছরান্তে জাকাত ফরজ হতে থাকবে। সুদি ব্যাংকে জমাকৃত টাকার প্রাপ্ত সুদ সওয়াবের নিয়ত ব্যতিত সদকা করে দেওয়া ওয়াজিব, সুদের টাকার ওপর জাকাত ফরজ হয় না। -রদ্দুল মুহতার: ২/২৬৭
মাসয়ালাঃ-৫
মহিলাদের ব্যবহৃত স্বর্ণ-রূপার অলংকার নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিসপত্রের অন্তর্ভুক্ত নয়, তাই শরিয়তের নির্দেশ অনুযায়ী সর্বাবস্থায় অলংকারের জাকাত প্রদান করা জরুরি। -সুনানে আবু দাউদ, হাদিস: ১৫৬৩, আল বাহরুর রায়েক: ২/২২৬
মাসয়ালাঃ-৬
আর সোনা বা রূপা কিংবা টাকা-পয়সা এগুলোর কোনো একটি যদি পৃথকভাবে নেসাব পরিমাণ না থাকে কিন্তু প্রয়োজনাতিরিক্ত একাধিক বস্তু মিলে সাড়ে বায়ান্ন ভরি রূপার সমমূল্যের হয়ে যায় তাহলেও তার উপর জাকাত ফরজ হবে। যেমন কারো নিকট কিছু স্বর্ণ ও কিছু টাকা আছে, যা সর্বমোট সাড়ে বায়ান্ন ভরি রূপার মূল্যের সমান হয় তাহলে তার উপরও জাকাত ফরজ হবে। -রদ্দুল মুহতার: ৫/২১৯
মাসয়ালাঃ-৭
স্বর্ণে ব্যবহৃত খাদ স্বর্ণের তুলনায় কম হলে খাদ স্বর্ণের হিসেবে চলে যায় এবং খাদ ও স্বর্ণ একত্রে হিসাব করে জাকাত দিতে হবে। -রদ্দুল মুহতার: ২/৩০০
মাসয়ালাঃ-৮
ইসলামি শরিয়তের দৃষ্টিতে নগদ টাকার জাকাত ওয়াজিব হওয়ার জন্য রূপার পাইকারি ক্রয়মূল্য ধর্তব্য নয়। বরং তার খুচরা বিক্রয়মূল্য অর্থাৎ বাজারদর হিসাবে ৫২.৫ তোলা রূপার যেই পরিমাণ টাকা আসে ওই পরিমাণ টাকা থাকলে জাকাত ওয়াজিব হবে। -ফাতাওয়ায়ে হিন্দিয়া: ১/১৮০
মাসয়ালাঃ-৯
বছরের মাঝে সম্পদ নিসাব থেকে কমে এলেও শুরু ও শেষে নিসাব পরিপূর্ণ থাকলে জাকাত ওয়াজিব হবে এবং বছর শেষে যত টাকা হাতে থাকে তার ৪০ ভাগের এক ভাগ জাকাত দিতে হবে। -আদ্দুররুল মুখতার: ২/২৮৮
মাসয়ালাঃ-১০
যদি ব্যবসার নিয়তে জমি ক্রয় করে তাহলে প্রত্যেক বছর তার বাজারমূল্য হিসাবে জাকাত আদায় করতে হবে। অন্যথায় ওই জমির উপর জাকাত আসবে না। -বাদায়েউস সানায়ে: ২/২০
মাসয়ালাঃ-১১
জমির উৎপাদিত ফসলাদির ওপর সাধারণত উশর আসে, জাকাত আসে না। তাই উৎপাদিত ফসলাদি বছর শেষে অতিরিক্ত হলেও জাকাত দিতে হবে না। তবে সেগুলো বিক্রির টাকার সঙ্গে অন্যান্য জাকাতের সম্পদ থাকলে তার সঙ্গে মিলিয়ে নিসাব পরিমাণ হলে জাকাত দেওয়া জরুরি।
মাসয়ালাঃ-১২
নিজের ও পরিবারের নিত্যপ্রয়োজনীয় খরচ বাদ দিয়ে দোকানের মাল ও ব্যবসায়িক পণ্যের মূল্য নিসাব পরিমাণ হলে বছরান্তে জাকাত আদায় করা জরুরি হবে। -বাদায়েউস সানায়ে: ২/২০
মাসয়ালাঃ-১৩
নগদ টাকা ঋণ দিলে ওই টাকা নিসাব পরিমাণ হলে ঋণদাতাকে ওই টাকার জাকাত আদায় করতে হবে। ঋণের টাকা হাতে আসার পর বিগত বছরগুলোর জাকাত একসঙ্গে আদায় করবে। তবে টাকা হাতে আসার পূর্বে আদায় করলেও জাকাত আদায় হয়ে যাবে। -বাদায়েউস সানায়ে: ২/১০
মাসয়ালাঃ-১৪
কারখানা ও ফ্যাক্টরির মালিকের ওপর ফ্যাক্টরির মেশিন ও বিল্ডিংয়ের মূল্যের জাকাত আসবে না। এ ছাড়া উপাদান, কাঁচামাল ও যে সমস্ত মাল বাকিতে বিক্রি করা হয়েছে এবং তার মূল্য উসূল করাও সম্ভব এসব কিছুর সমষ্টি নিসাব পরিমাণ হলে তার ওপর জাকাত ওয়াজিব হবে। -আদ্দুররুল মুখতার: ২/২৬৭, ফাতাওয়ায়ে উসমানি: ২/৩৯
মাসয়ালাঃ-১৫
ব্যবসার উদ্দেশ্য ছাড়া ক্রয়কৃত জমি ক্রয়ের পর বিক্রয়ের নিয়ত করলেও তার ওপর জাকাত আসবে না, কেননা ওই জমি ব্যবসার উদ্দেশ্যে খরিদ করা হয়নি। হ্যাঁ, বিক্রয়ের পর মূল্য নিসাব পরিমাণ হলে বছরান্তে জাকাত আসবে। -মাবসুতে সারাখসি: ২/১৬৯, আদ্দুররুল মুখতার: ২/২৭২
মাসয়ালাঃ-১৬
খালি জায়গায় রোপণকৃত গাছের কোনো জাকাত দিতে হবে না। হ্যাঁ, বিক্রির পর তার মূল্য নিসাব পরিমাণ হলে বা সে মূল্য অন্য অর্থের সঙ্গে মিলে নিসাব পূর্ণ হলে জাকাত আদায় করতে হবে। -তাবঈনুল হাকায়েক: ১/২৯১
কোন কোন সম্পদের উপর জাকাত ফরজ নয়
মাসয়ালাঃ-১৭
সর্বমোট হিসাব থেকে ঋণের পরিমাণ টাকা বাদ দেওয়ার পর অবশিষ্ট টাকা নিসাব পরিমাণ হলে জাকাত দিতে হবে। অন্যথায় জাকাত দিতে হবে না। -মুসান্নাফে আবদুর রাজ্জাক, হাদিস: ৭০৮৫
মাসয়ালাঃ-১৮
মাসয়ালা: নিজের ব্যবহৃত বা ব্যবসার কাজে ব্যবহৃত হয় এমন গাড়ির মূল্যের ওপর জাকাত আসবে না। তবে এর মাধ্যমে উপার্জিত ভাড়ার টাকা জাকাতের মূল হিসাবের সঙ্গে যোগ করতে হবে। -রদ্দুল মুহতার: ২/২৬৫
মাসয়ালাঃ-১৯
ভাড়া দেওয়া বাড়ি ও মার্কেটের মূল্যের ওপর জাকাত আসবে না। তবে এগুলো থেকে অর্জিত ভাড়া যদি নিসাব পরিমাণ হয় তাহলে বছরান্তে জাকাত আসবে। -ফাতাওয়ায়ে হিন্দিয়া ১/১৮০
মাসয়ালাঃ-২০
যে সমস্ত মালের জাকাত দেওয়া ওয়াজিব হওয়ার পরও ইচ্ছায় বা অনিচ্ছায় জাকাত আদায় করেনি ওই মাল চুরি বা ধ্বংস হয়ে গেলে ওই সম্পদের জাকাত দিতে হবে না। তবে জাকাত আদায় করতে বিলম্ব করার গোনাহের জন্য তাওবা করা জরুরি। -রদ্দুল মুহতার: ২/২৮৩, ফাতাওয়ায়ে হিন্দিয়া: ১/১৭০
সর্বশেষ
আজকের আলোচনার বিষয় হল সকল সম্পত্তির উপর যাকাত ফরজ। একজন মুসলিম হিসেবে আমার জন্য কখন যাকাত ফরজ এবং কোন সম্পদের জন্য যাকাত ফরজ তা আপনি যদি নিশ্চিত না হন তবে আজকের নিবন্ধে জেনে নিন। আমরা আশা করি এই নিবন্ধটি মনোযোগ সহকারে পড়লে আপনি যাকাত সম্পর্কে অনেক কিছু জানতে পারবেন। এই নিবন্ধটি ব্যাখ্যা করে যে কিছু সম্পদের জন্য যাকাত বাধ্যতামূলক। আপনি যদি ইসলাম সম্পর্কে এই ধরনের আরও নিবন্ধ পড়তে চান এবং অন্যান্য বিষয় সম্পর্কে আরও জানতে চান তবে অনুগ্রহ করে আমাদের ওয়েবসাইট দেখুন। ধন্যবাদ
Post a Comment